Home Bangabandhu Inter University Sports Championship আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট: জার্নি অব জগন্নাথ

আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট: জার্নি অব জগন্নাথ

by Moin Hasan
0 comment

যা লিখতে যাচ্ছি তাতে অর্জনের মাত্রা আরেকটু বেশি থাকলেই ভাল লাগত। এই তো স্বাভাবিক, যত অর্জন- তত আনন্দ। তবে এখানে ‘অর্জন’ শব্দটা তথাকথিত অর্জন দিয়ে মাপলে ভুলই হবে। ক্রিকেট সংক্রান্ত অর্জন আবার একটু আলাদাই মনেহয় আমার কাছে। জয় পাওয়া অনেকটাই গুরুত্বপূর্ণ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবুও আরো অনেক জিনিস ক্রিকেটে থাকে, যা শুধু জয়ের অর্জনের অর্জনকেই আলোকিত করেনা, আরো অনেক-পুরো ক্রিকেট সময়টাকেই তুলে আনে মনেহয়। বলছিলাম ক্রিকেট নিয়ে, আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট। ক্রিকেটের আয়োজনটি ছিল বঙ্গবন্ধু ইন্টার ইউনিভার্সিটি স্পোর্টস চ্যাম্পিয়নশিপের অংশ। যেখানে ক্রিকেট ছাড়াও ফুটবল, টেবিল টেনিস, ভলিবল, দাবা ইত্যাদি আরো বেশ কিছু ক্যাটাগরিতেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অংশগ্রহণ করে।

নাজমুল একদিন হঠাৎ ফোন দেয়। সেপ্টেম্বরের ৭-৮ তারিখ হবে। নাজমুল আমাদের বন্ধু, একই ডিপার্টমেন্টের, বিকেএসপি শেষ করে এখন আমাদের সাথে। জানায়, টিমের ফাস্ট বোলারদের ইঞ্জুরি আছে, ফাস্ট বোলার দরকার, আমি যদি চাই, তবে আসতে পারি। আমি একটু অফ যাচ্ছিলাম সেসময়। আমি বললাম, অবশ্যই জানাবো। মোটামুটি সেদিন রাতেই ভাবনা-চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেই। পরেরদিন নাজমুলকে সন্ধ্যাবেলা জানাই, কাল থেকে যাচ্ছি। আন্তঃবিভাগ ক্রিকেট খেলার সময়ে কেনা কেডসটা বাড়িতে ছিল। অন্য এক জোড়া কেডস ছিল, তাই পরে পরদিন প্র্যাক্টিসের জন্য বের হই। সকালে একটা ক্লাস ছিল সেদিন। ক্লাসটা করলাম আগে। পরে ভার্সিটির মাইক্রোবাসে করে যেদিকে কোনদিন যাই নাই সেদিকে রওনা দিলাম। জায়গাটার নাম দেখলাম ইকুরিয়া। কেরানীগঞ্জের দিকে। আমাদের দ্বিতীয় ক্যাম্পাসটা যেখানে তৈরি হচ্ছে সেদিকেই। একটা প্রাইমারি স্কুল, সেখানে নেট করা আছে। অনেক বেশি রোদ সেদিন। প্রচুর ঘাম ঝড়ল। আমরা তুমুল প্রাক্টিস শেষ করে আবার ক্যাম্পাসে ফিরলাম।

জানিয়ে রাখি, আমাদের টিমের সার্বিক দায়িত্বে যিনি ছিলেন, তিনি স্যার পুষ্পেন সরকার। যার দারুণ দক্ষতা আমি খেয়াল করলাম, আমাদের মতো ছেলেদের কিভাবে ম্যানেজ করতে হয় সেই ব্যাপারে। দলে ৮ জন ছিল বিকেএসপি থেকে পড়াশোনা করে আসা। মূলত ক্রিকেট খেলে আসা। তো সবাইকে নিয়ে দলটাকে বেশ ভালোই গোছাচ্ছিলেন বলেই দেখলাম- পরে আরো বেশ কয়েকদিনের প্রাক্টিসে এবং ম্যাচে তা স্পষ্ট হয়। একদিনের প্র্যাক্টিসে পুষ্পেন স্যার বনমালীর বল দেখে বলছিলেন, “এইটাই বনমালী, এই বলেই ছয় খাবি, এই বলেই উইকেট পাবি।“, আমি পাশেই বসে ছিলাম। স্যারের এই কথা সেসময় আমার বেশ পছন্দ হয়। মনেও আছে তাই। বনমালী হচ্ছে আমাদের খুব ভালো ফাস্ট বোলার।

আমাদের প্রথম ম্যাচ ছিল রুয়েটের সাথে। সেই ম্যাচটায় আমরা ওয়াকওভার পাই। কারণ রুয়েট অনুপস্থিত থাকে। দ্বিতীয় ম্যাচটা ছিল ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির সাথে। ভেন্যুঃ গ্রীন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, রূপগঞ্জ। দিনটা ছিল সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ। দুপুর একটায় খেলা। ভেন্যু যেহেতু দূরে, আমরা সকাল সকালই রওনা দেই। ক্রিকেটিং ওয়েদার বলতে যা বোঝায়, তা সেদিন ছিল। সুন্দর রোদ ঝলমলে পরিবেশ, যা আগের ম্যাচের দিন একদমই ছিল না। আমরা সেদিনের ম্যাচটা জিতলাম। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ১০ ওভারে ৯৫ রান করে আমাদের দল। ৯৬ রানের টার্গেট। ১০ ওভারের খেলায় বেশ ভালো টার্গেট হিসেবেই ধরা হয়। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি ব্যাট করতে নেমে নির্ধারিত ১০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে ৩৭ রান তুলতে সক্ষম হয়। আমাদের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ক্যাপ্টেন আবীর, জিসান, সাজ্জাদ, রোহান ভালো করে। আবীরের ৩২ রানের কথা খেয়াল আছে। জিসান সম্ভবত ২৪ করে। স্মৃতি থেকে যতটুকু মনে পড়ে। বোলারদের মধ্যে স্পিনাররা খুবই ভালো করে; আশিক, নাজমুল, জিসান। সাথে অন্যরাও। সব মিলিয়ে ব্যাট-বল, আমাদেরই দিন ছিল নিশ্চিতভাবেই। প্রথম ম্যাচের ওয়াকওভার আর দ্বিতীয় ম্যাচ জিতে আমরা সেকেন্ড রাউন্ডে উঠে যাই। সেকেন্ড রাউন্ডে তিনটা ম্যাচ। প্রতিটা ম্যাচের ভেন্যু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মাঠ। সেকেন্ড রাউন্ডে আমাদের প্রথম ম্যাচ ছিল লিডিং ইউনিভার্সিটির সাথে। সিলেটের একটা ইউনিভার্সিটি। এই ম্যাচটা সবচেয়ে স্মুথ জয় হিসেবে আমি দেখি। লিডিং ইউনিভার্সিটি প্রথমে ব্যাট করে, আমাদের জন্য টার্গেট দাঁড়ায় ৬৯ রান। আমরা মাত্র এক উইকেট হারাই, ৮.২ ওভারে ৬৯ রান করে ফেলি। অর্থাৎ ৯ উইকেটের জয় আসে আমাদের। জয়টা ১০ উইকেটেরই হতে পারতো। তা হয়নি, যেহেতু খেলাটা ক্রিকেট। যখন-তখন, যা-তা। আমাদের দ্বিতীয় ম্যাচ ছিল স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাথে। স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি তুলনামূলক বেশ ভালো দল। তা নিয়ে টুকটাক আলোচনা আমাদের হয়। তবুও অপনেন্ট নিয়ে সবচেয়ে কম মনেহয় আমরা আলোচনা করেছি। টিমে এটাকে অনুৎসাহিত করা হতো। যেহেতু অপনেন্টের পুরো টিম সম্পর্কে সেভাবে জানা সম্ভব না, সেহেতু আলাদা করে টুকটাক আলোচনাগুলি ভালোর চেয়ে মন্দই হয় বলে বিবেচনা করা হতো। আর সেই আলোচনা করবার অতো সময়ও ছিলনা। খেলা ছিল একদমই বিরতিহীন।

স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রথমে ব্যাট করতে নামে। ইনিংসের শুরুই হয় চার দিয়ে, খেয়াল আছে। আর প্রথমদিকে ওদের রান বেশ ভালোই ছিল। তবে আমাদের টাইট বোলিংয়ে তেমন সুবিধা স্টামফোর্ড করতে পারেনা। এদিন নাজমুল হ্যাট্রিকসহ চার উইকেট নেয়। ফয়সাল ভাই দারুণ বল করে এদিন। বনমালী, ওমর, আশিক সবাই খুব টাইট ছিল। যার ফলে, ৩৯ রানেই ওদের ৮ উইকেট পড়ে যায়। তখন নবম ওভারের খেলা চলছে। এই সময় আসে বৃষ্টি। বৃষ্টি শেষে সিদ্ধান্ত হয়, আমরা ব্যাটিং শুরু করব। আমাদের জন্য টার্গেট আসে ২১, যা ৫ ওভারে করতে হবে। স্টামফোর্ড যে ভাল দল, তা তারা প্রমাণ দিতে শুরু করল দ্বিতীয় ইনিংসে। তাদের খুবই ভালো বল, জিসান আর রোহান- ওদের ইনিংস শুরু করতে ভালোই স্ট্রাগল করতে হয়। শেষমেশ গিয়ে এক ওভারে আমাদের ৬ রান দরকার পড়ে। স্ট্রাইকে তখন আমাদের ক্যাপ্টেন আবীর। আবীর যথেষ্ট কুল, আমি যতটুকু দেখে বুঝি। ও যে কিছু করবে, তা আগের ওভারে ওর ঠান্ডা থাকা অবস্থা দেখেই আমার কিছুটা ধারণা হয়েছিল। শেষ ওভারের প্রথম বলেই আবীর ধারণার মান রাখল। এক দারুণ ছক্কায় আবীর খেলা শেষ করে। দ্বিতীয় রাউন্ডে আমরা আরেকটা ম্যাচ জিতে যাই। আশা করতে থাকি কোয়ার্টারে যাবার। পুষ্পেন স্যার বেশ বাহবা দিলেন এদিন। বাহবা দিল আরো অনেকেই। অফলাইন- অনলাইন সবখানে। পরের দিন দ্বিতীয় রাউন্ডের শেষ ম্যাচ।

সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখ। প্রতিপক্ষ সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটি। একই ভেন্যু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিন ওয়ার্ম আপের সময় জিসান বলল, আমাদের মধ্যে একটা ক্যাজুয়াল ভাব চলে আসছে, যেটা ভালো সাইন না। যেন আমাদের একটু সতর্ক হওয়া দরকার। জিততে হবে শেষ ম্যাচটাও, নাহলে আছে নানা সমীকরণ। সাউথ ইস্টের সাথে প্রথমে ব্যাট করতে নেমে আমরা তেমন সুবিধা করতে পারলাম না। এমন না যে, সাউথইস্ট খুব ভাল বল করল। ক্রিকেটে যা হয়, তাই। এদিন আমাদের ব্যাটে আমরা সুবিধা করতে পারিনা। ৯.৫ ওভারে সব উইকেট হারাই। টার্গেট দিতে পারি মাত্র ৬৩ রান। কিছুটা হতাশা তখনই আমাদের মধ্যে কাজ করে। কারণ, আগের ম্যাচগুলিতে আমাদের এরকম কোন পরিস্থিতি হয় নাই। সব ম্যাচেই আমাদের স্মুথনেস ছিল। বোলিংয়ে আমাদের দখল ভাল, তা বোলাররা প্রমাণ করতে চেষ্টা করে। যথেষ্ট চেষ্টাই করে। কিন্তু টার্গেট এত কম, শেষমেশ গিয়ে আর পারা গেল না। ম্যাচটা শেষ ওভার পর্যন্ত আমরা নিয়ে যাই। ৯ ওভার পর্যন্ত সাউথইস্টকে খেলতে হয়, জিতে যায় সাউথইস্ট। অনেক বেশি হতাশা, দুঃখ ভর করা শুরু করে সবার মধ্যে। প্রথম রাউন্ড থেকে জিতবার পর, আমরা সবাই অনেক বেশি আশা নিয়ে ছিলাম। হঠাৎ এরকম হারের ধাক্কা সামলানো তাই কঠিন। সবাই জানে এখন যেতে হবে নানারকম সমীকরণের মধ্যে।

তবুও সেদিন রাত নয়টা পর্যন্ত অপেক্ষা। আমাদের গ্রুপ থেকে ৪ দলের ৩ দলেরই ২ ম্যাচ করে জয় আছে। গ্রুপে সবাই আলোচনা করছিল, সম্ভাবনা এখনো আছে। ক্যাপ্টেন বলছিল, ধৈর্য্য রাখতে। কেউ দোয়া পাঠায়, তা পড়তে বলে। মনে হচ্ছিল, শেষ মূহুর্তে মনেহয় পার হয়ে যাব। আমাদের সাথে সমীকরণের মারপ্যাচ চলছিল স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির। রাত নয়টা বা সাড়ে নয়টার দিকে গ্রুপ থেকে জানতে পারি, এ যাত্রা এখানেই শেষ। স্টামফোর্ড কোয়ার্টার খেলবে। সবার মন খারাপ। নাজমুল সেদিন রাতেই কক্সবাজার রওনা হয়। অন্যরাও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে যায়। ক্রিকেট যে এমনই, কখনো ভাসায় আনন্দে, তো কখনো ডোবায় বিষাদে। এভাবেই শেষ হয় আমাদের জগন্নাথের এবারের ক্রিকেট জার্নি। তবুও প্রথমে বলা সেই কথাই সই, ক্রিকেটের অর্জন এত হিসাব-নিকাশ আর অংক কষে হয় না। আরো অনেকেই হয়তো একমত হবেন- ক্রিকেটে এমন কিছু নির্যাস থাকে, যা অন্য অনেক হিসাবের ঊর্ধ্বে।

You may also like

Leave a Comment